বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বহীন ছাত্রলীগ
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লাভের আশায় সংঘর্ষে জড়ানোর অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্যবার চাঁদাবাজি, ছিনতাই, টেন্ডারবাজি, বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন জালিয়াতি এবং অস্ত্র ব্যবসার মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এসেছে।
সম্প্রতি ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ আলোচনায় আসে ১৮ এপ্রিল নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের পর। এ ঘটনায় কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মৃত্যু হয় দোকানকর্মী মোহাম্মদ মুরসালিনের। দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত পৃথক মামলা তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। যেসব হেলমেটধারীরা নাহিদকে কুপিয়েছিল তাদের ছয়জনকে শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যাদের হাতে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ছিল। এদের সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। এখানে যাদের নাম এসেছে তাদের কয়েকজন অতীতেও বিভিন্ন অপরাধ অপকর্মে জড়িয়েছেন।
গত ৩০ মার্চ টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ভেতরে হামলা চালায় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশী এক নেতা হেলমেট পরে অস্ত্র নিয়ে অংশ নিয়েছেন বলে ইঙ্গিত মিলেছে গোয়েন্দাদের হাতে থাকা এক অডিও রেকর্ডে। গত ৪০ দিনের মধ্যে আরেক আলোচিত ঘটনা নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতের ১৫টি দোকান ভাঙচুর। চাঁদা না পেয়ে এই হামলা চালানো হয়।
গত ২০ এপ্রিল সায়েন্সল্যাবের বায়তুল মামুর মসজিদ মার্কেট এলাকার একটি দোকান থেকে আটটি পাঞ্জাবি নিয়ে টাকা না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। এমন অসংখ্য অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত কমিটি হলেও তার বেশিরভাগই আলোর মুখ দেখেনি।
ঢাকা কলেজে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হলগুলোতে এখন প্রশাসনের নামমাত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কেবল উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রদের হল ছাড়া অন্য সাতটি হলে ছাত্রলীগের কথাই শেষ কথা। হলে থাকতে হয় ছাত্রলীগের ‘অনুকম্পায়’। যেখানে ছাত্রদল বা বিরোধী ছাত্র সংগঠন পরিচয়ে থাকার সুযোগ নেই।
ফলে হলে যারা থাকেন মোটামুটি সবার পরিচয়ই ছাত্রলীগ। পদ না থাকলেও কর্মী হিসেবে নিয়মিত যোগ দিতে হয় ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে। কমিটি না থাকলেও শীর্ষ পদপ্রত্যাশী নেতারাই এখন ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এরা কোনো শিক্ষার্থীকে কোথাও ডাকলে সেখানে যেতে বাধ্য হয় সবাই। এভাবে অতীতে কোনো অপরাধের রেকর্ড না থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থী জড়িয়ে পড়েন অপরাধ-অপকর্মে। পরে বিপদে পড়লে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তাদের ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। অনেক ঘটনায় এভাবে বহু শিক্ষার্থী ‘ফেঁসে গেছেন’ বলে অভিযোগ আছে। এমন আচরণকে ছাত্রলীগের ‘দ্বিচারিতা’ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এটিএম মইনুল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, নিউমার্কেটে সংঘর্ষের ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোপূর্বে বিভিন্ন ঘটনার তদন্ত আলোর মুখ না দেখার বিষয়ে তিনি বলেন, তখন তো আমি ছিলাম না, তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করার সুযোগ নেই। ছাত্রলীগের সিটের নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তিনি বলেন, ইন্টারমিডিয়েটের হলের নিয়ন্ত্রণ আমাদের রয়েছে।
অনার্সেরগুলো আমরা আরও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। এখন এর বাইরে যদি কেউ থেকে থাকে, সেটা আসলে আইডেন্টিফাই করা সম্ভব হয় না। ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন দোকান থেকে টাকা না দিয়ে পণ্য আনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ রকম অনেক কথা বাইরে শুনি। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। আসলে আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
ছাত্রলীগ সূত্র জানায়, অবস্থানগত কারণে এই ইউনিটটিকে বরাবরই গুরুত্ব দিয়ে আসছে সংগঠনটি। কিন্তু দীর্ঘদিন কমিটি না থাকায় ঢাকা কলেজ আরও বেশি বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করেন সেখানকার নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, সেখানে এখন ‘কেউ কারও কথা মানে না’ এমন অবস্থা বিরাজ করছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কলেজ ইউনিটের মেয়াদ এক বছর। সেই হিসাবে প্রতিবছর ছাত্রলীগের একটি করে নয়টি কমিটি হওয়ার কথা। সেখানে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে গত নয় বছরে ঢাকা কলেজে মাত্র একটি কমিটি হয়েছে। তাও পূর্ণাঙ্গ কমিটি নয়, তিন মাসের জন্য গঠিত আহ্বায়ক কমিটি।
২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর নূরে আলম ভূঁইয়া ওরফে রাজুকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠন করা হয়। দুই মাসের মাথায় ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ান তাদের অনুসারীরা। বহিষ্কার হন আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়কসহ কমিটির ১৯ নেতা।
এরপর থেকে নেতৃত্বশূন্য রয়েছে ঢাকা কলেজ। এর আগে প্রায় এক দশক পর ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ৫৫ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেই কমিটিও ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মেধাবী ছাত্র ফারুক হোসেন হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে স্থগিত হয়।
যে কোনো সংঘর্ষের পরপরই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি নেই। সেজন্য সেখানে কিছু ঘটলে তার দায় ছাত্রলীগের নয়। অথচ ঢাকা কলেজে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ছবি সংবলিত বড় বড় ফেস্টুন। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের জন্মদিনও পালন করা হয়েছে বিশাল আয়োজনে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কেন্দ্রীয় সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে নিয়ে নিয়মিত পোস্ট দেন তারা। এসব বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে একাধিকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি।